শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন




আন্তর্জাতিক বাজারে এখন নিম্নমুখী সব পণ্যের দাম

আন্তর্জাতিক বাজারে এখন নিম্নমুখী সব পণ্যের দাম

নিউজ ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার আগের তুলনায় কমছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি, খাদ্যশস্য, শিল্প কাঁচামাল ও সারের মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। কিন্তু এখন এসব পণ্যের নিম্নমুখি অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে।

পণ্যবাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের (পিংকশিট) মার্চ সংস্করণেও দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি বাদে অধিকাংশ পণ্যেরই দাম এখন কমতির দিকে। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) তুলনায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসব পণ্যের দাম কমেছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।

আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পণ্যবাজারে দাম প্রধানত বিজনেস সাইকেল (নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমার ব্যবধানে অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলোর পুনরাবৃত্তি) দিয়ে প্রভাবিত। অর্থনীতি গতিশীল হলে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্যের চাহিদাও থাকে বেশি। আবার অর্থনীতি মন্দার ধারায় থাকলে চাহিদার পরিমাণও থাকে কমতির দিকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ ধারাটিতে ব্যাপক মাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে কভিডের প্রাদুর্ভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়ে তোলা ও দেশে দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও সংকোচন। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভীতির সবচেয়ে বেশি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা, তারল্য ও রিজার্ভ সংকট এবং ক্রেডিট ক্রাঞ্চের (ঋণের দুষ্প্রাপ্যতা) আশঙ্কা। মন্দার এ আশঙ্কা প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক পণ্যবাজারেও। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম এখন কমছে।

জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম গত এক বছরে কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে ডব্লিউটিআইয়ের গড় মূল্য ছিল প্রতি ব্যারেল ৯৪ ডলার ৫০ সেন্ট। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ৭৬ ডলার ৮০ সেন্টে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম ১৬ শতাংশ কমে প্রতি ব্যারেল ৯৯ ডলার থেকে নেমে এসেছে ৮২ ডলার ৭০ সেন্টে। দুবাই ক্রুডের মূল্যও প্রায় ১৬ শতাংশ কমে ৯৬ ডলার ৫০ সেন্ট থেকে ৮১ ডলার ২০ সেন্টে নেমেছে।

এদিকে ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আরও কমবে। এ বিষয়ে ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক গতি কমে তা গত বছর ৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর বৈশ্বিক অর্থনীতি আরও শ্লথ হয়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশে প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসার পূর্বাভাস রয়েছে। চলতি শতকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এটিকেই সবচেয়ে দুর্বল প্রবৃদ্ধির ধারা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

সরবরাহ সংকট ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উৎপাদনকারী দেশগুলোর স্থানীয় বাজারে অস্থিতিশীলতার কারণে গত বছরের শুরুর দিকে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে শুরু করে। তবে বর্তমানে চাহিদায় নিম্নমুখিতার কারণে ভোজ্যতেলের দামও কমতে শুরু করেছে। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে নারিকেল তেলের দাম ছিল প্রতি টন ২ হাজার ১৩১ ডলার। গত ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ১ হাজার ৮৭ ডলারে। একইভাবে পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ৫৪৮ ডলার থেকে ৯৫০ ডলারে এবং সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার ৬৭৪ ডলার থেকে ১ হাজার ২৪৩ ডলারে নেমেছে।

খাদ্যশস্যের বাজারে বৃহৎ দুই সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক চাহিদার ২৮ শতাংশ পূরণ করে দেশ দুটি। এ দুই দেশের যুযুুধান দেশ দুটি থেকে সরবরাহ এক ধরনের বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী গমের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে দেশ দুটি থেকে শস্য রফতানি শুরু হলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। বর্তমানে পণ্যটির দাম বেশ নিম্নমুখী রয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ায় গমের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন, অস্ট্রেলিয়ায় পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি উৎপাদন ও বিভিন্ন দেশে সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে গমের দাম এখন নিম্নমুখী। বাজারে গমের গড় মূল্য ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়সীমার মধ্যে ছিল প্রতি টন ৪১৭ ডলার। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ৩৯৪ ডলার ৮০ সেন্টে।

একইভাবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দামও এখন নিম্নমুখী। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্যটির গড় মূল্য ছিল প্রতি টন ২৯৮ ডলার ২০ সেন্টে।

আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন জাস্টিনাস লিউইমা ও আলেকসান্দ্রা সভিদলার। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির দুই বিশ্লেষক বলেন, ‘২০২৩ সালজুড়ে পণ্যবাজারে নিম্নমুখিতার বড় কারণ হয়ে উঠবে বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথতা। শিল্পোৎপাদন শ্লথ হয়ে আসায় ভোক্তা ও বি২বি (বিজনেস টু বিজনেস) পর্যায়ে চাহিদা থাকবে কমতির দিকে। একই সঙ্গে ঋণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মন্দার আশঙ্কা দীর্ঘায়িত হওয়ার বিষয়গুলোও বাজারে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। জ্বালানি ও শিল্প ধাতুর বাজারে চাহিদা কমে আসতে পারে।’

‘অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারাও তাদের ভোগব্যয় কমিয়ে দিতে যাচ্ছেন। ফলে খাদ্যপণ্যের বাজারেও চাহিদা মন্দার বিষয়টি বড় ধরনের প্রভাবক হয়ে উঠবে।’

অর্থনীতিবিদদের এ মন্দার আশঙ্কা এখন জেঁকে বসেছে শিল্প খাতের কৃষিজ কাঁচামালের বাজারেও। গত বছরের শুরুর দিকে তুলার কেজিপ্রতি মূল্য ছিল ৩ ডলার ২ সেন্ট। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ২ ডলার ১৯ সেন্টে। একইভাবে রাবারের দাম কেজিপ্রতি ২ ডলার ৭ সেন্ট থেকে নেমে এসেছে ১ ডলার ৬২ সেন্টে।

দেশে খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন ধাতব পণ্যের অন্যতম বৃহৎ বাজার অবস্থিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও এখানকার পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, গম, চালসহ বিভিন্ন খাদ্যের দাম এখনো কমেনি। বরং রোজার মাসের বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যবাজারে সব ধরনের খাদ্যশস্যের দাম তুলনামূলক আগের চেয়ে বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে খাদ্যশস্যের দাম না বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া হলেও বাজারে এখন পর্যন্ত তা কমতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলারের অবমূল্যায়ন ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বাজারে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিফলন পেতে সময় লাগবে।

বৈশ্বিক শিল্প খাতে উৎপাদনে মন্দার প্রভাব এখন ব্যবহারিক ধাতুর আন্তর্জাতিক বাজারে। গত বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে শিল্প ধাতুগুলোর মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম বিক্রি হচ্ছিল প্রতি টন ৩ হাজার ২৫০ ডলারে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ২ হাজার ৪১৬ ডলারে। একইভাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতি টন তামার দাম ৯ হাজার ৯৮৫ থেকে ৮ হাজার ৯৩৭ ডলারে নেমেছে। আকরিক লোহার দাম ১৪২ ডলার ৫০ সেন্ট থেকে ১২৭ ডলার ৬০ সেন্টে নেমেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিসংক্রান্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যানও পণ্যগুলোর বাজারে খুব একটা প্রভাবক ভূমিকা নিতে পারেনি।

সারের আন্তর্জাতিক বাজারেও এখন দাম বেশ নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিএপি ও টিএসপি সারের দাম ছিল প্রতি টন যথাক্রমে ৭৯৪ ডলার ৯০ ও ৭১৫ ডলার ৬০ সেন্ট। এর মধ্যে ডিএপি সারের দাম গত ফেব্রুয়ারিতে নেমেছে ৬১২ ডলার ৫০ সেন্টে। টিএসপি সারের মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি টন ৫৪৭ ডলার ৫০ সেন্টে। একইভাবে ইউরিয়া সারের দাম এক বছরের ব্যবধানে ৮২১ ডলার থেকে নেমে এসেছে ৩৫৭ ডলার ৫০ সেন্টে।

দাম কমতির দিকে থাকলেও ডলার সংকটে এখনো পণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ বিষয়টিও দেশের বাজারে সরবরাহ সংকট দীর্ঘায়িত করছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

নিউজটি শেয়ার করুন







© All rights reserved © uttorersomoy.com
Design BY BinduIT.Com