রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ অপরাহ্ন




সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন

সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন

রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি :
গাইবান্ধার প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো মসজিদ, রাজ প্রাসাদ, জমিদার বাড়ী ও জোতদার বাড়ি। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে মাত্র তিনটি পুরাকীর্তির তালিকায় নাম তুলেই দায়িত্ব সেরেছে প্রত্মতত্ত¡ অধিদপ্তর। সংরক্ষণের অভাবে নিঃশ্চিহ্ন ও দখল হয়ে গেছে বেশ কিছু স্থাপনাও। শুধু তাই নয়, জাতীয় ওয়েব পোর্টাল ‘গাইবান্ধাডটগভডটবিডি’তেও নেই সবগুলো প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের তথ্য ও ছবি। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন কখনো উদ্যোগ নেয়নি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও সাইনবোর্ড লাগালে সুস্থ বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সেইসাথে প্রচার-প্রচারণাও না থাকায় গুরুত্ব হারিয়েছে প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে এ জেলার পুরনো ইতিহাস।
গাইবান্ধা জেলার জাতীয় ওয়েব পোর্টাল এবং সরেজমিনে দেখা গেছে, গাইবান্ধা সদর উপজেলার ঘাগোয়া ইউনিয়নের মীরের বাগান গ্রামে আছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মীরের বাগান ঐতিহাসিক শাহ সুলতান গাজীর মসজিদ। যা ১৩০৮ সালে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী নামের এক ব্যক্তি আবিস্কার ও সংস্কার করেন। পরবর্তীতে শাহ সুলতান নামে এক ধর্মযোদ্ধার নাম এর সাথে জড়িয়ে যায় ও তার নামেই মসজিদটি পরিচিতি পায়। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে এখানে মেলা বসে।
গাইবান্ধা পৌরসভার পূর্বপাড়ায় অবস্থিত লোন অফিস। এর নির্মাণশৈলী সহজেই আকৃষ্ট করে মানুষকে। জেলা শহরের পুরাতন বাজার থেকে বালাসী রোডে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের সামনেই এই ভবনটি। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজা-বাদশাহ বা জমিদাররা এই অফিস থেকে লোন দিতেন এবং তা আদায় করতেন। কিন্তু কালক্রমে পরিত্যক্ত থাকার পর এখন সেখানে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার।
পাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ পূর্ব বাংলার সমতটে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা দেব রাজ বংশ ও পুন্ড্রনগরের আওতাভুক্ত ছিল রাজা বিরাট। সেই রাজা বিরাটের গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজা বিরাট এলাকায় রাজ প্রাসাদসহ তিনটি স্থাপনা দীর্ঘদিন আগেই মাটির নিচে দেবে গেছে। দেবে যাওয়া রাজপ্রাসাদ ও অন্য দুইটি স্থাপনার উপরের অংশ এখন মাটিতে পরিণত হয়েছে। দেখে বোঝা যায়, এসব শুধুমাত্র উঁচু মাটির ঢিবি বা মাটির স্তুপ। বাহিরে থেকে প্রাসাদ ও স্থাপনা দুটির ভবনের ইট দেখা যায়। রাজপ্রাসাদের আশেপাশেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ঘরবাড়ীও। বিভিন্ন সময়ে গোবিন্দগঞ্জের রাজাহার ও পাশ্ববর্তী শাখাহার ইউনিয়নের পুকুর থেকে পাওয়া বেশ কিছু মূল্যবান কষ্টি ও বিষ্ণু পাথরের মুর্তি উদ্ধার করে পুলিশ।
সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশাহদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে পরিচিত গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বর্ধনকুঠির জায়গায় গোবিন্দগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষও কখনো স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দুইটি ভবনের দেয়াল ও কক্ষের ভেতরে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের আগাছা। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে রাজা রামপাল এখানে বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করেন।
ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জের কামারদহ ইউনিয়নের মাস্তা গ্রামে রয়েছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রাচীন মাস্তা মসজিদ। মসজিদের নির্মাণ কৌশল ও স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী ধারনা করা হয়, মসজিদটি মোঘল আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত।
পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের ঘোড়াঘাট সড়ক সংলগ্ন নুনিয়াগাড়ী এলাকায় ইমামসহ মাত্র চার থেকে পাঁচজন নামাজ আদায় করা যেতো এক গম্বুজবিশিষ্ট কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদে। সবচেয়ে ছোট মসজিদ হিসেবে বেশ সুপরিচিতি পেয়েছে মসজিদটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবাব সুজা-উদ দৌলার আমলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে ধারনা করা হয়।
সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের কালীবাড়ী পাড়া গ্রামে ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহন করা উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যকার-শিল্পী, চলচ্চিত্রকর তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়ীটিও নিঃশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। শুধু রয়েছে সেই আমলের একটি পাকা বাড়ী, টিনের ঘর, কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ ও শ্বেত পাথরের একটি বৃষ মন্দির। জমিদার তুলসী লাহিড়ীর বসতভিটায় এখন গড়ে উঠেছে তার বংশধরদের নতুন নতুন বাড়ী।
ব্রিটিশ শাসনামলে সাদুল্লাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বড় জামালপুর গ্রামে জামালপুর শাহী মসজিদটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাটির নিচে চাপা পড়ে। পরে জনবসতি না থাকায় সেটি বটবৃক্ষ ও বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। দেশ স্বাধীনের আগে এক ঝড়ে মসজিদটি দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকে সেটিকে গায়েবী মসজিদ বলে থাকেন স্থানীয়রা। এটি একটি তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।
১২৫২ সালে নির্মিত সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের রামভদ্র গ্রামে জমিদার বাড়ীর (বামনডাঙ্গা জমিদারবাড়ী) কোন স্মৃতিচিহ্নই আর নেই। জমিদার বাড়ীর জায়গায় গড়ে উঠেছে ধর্মীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বসতবাড়ী।
এ ছাড়া সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের হাট ভরতখালী এলাকায় জমিদার বাড়ী, সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব কেশালীডাঙ্গা গ্রামের জোতদার প্যারীমাধব সরকারের বাড়ী, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের কাশদহ গ্রামের জোতদার ইয়াকুব উদ্দিন সরদারের বাড়ী ও সুন্দরগঞ্জের ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের উত্তর রাজিবপুর মধ্যপাড়া গ্রামে তিন গম্বুজবিশিষ্ট ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত মসজিদটি শুধু টিকে রয়েছে কালের স্বাক্ষী হিসেবে। আর অন্যসব স্থাপনা নষ্ট হয়ে গেছে অনেককাল আগেই।
এ ছাড়া পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের বরিশাল গ্রামে জোতদার বাড়ীর আর কোন কিছুই নেই। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে বহুবছর আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ফুলছড়ির রসুলপুরের জোতদার বাড়ীটিও। ২০১০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে থাইল্যান্ডের রাজকন্যা মাহা চাক্রী শিরিনধর্ন কামারপাড়ার পূর্ব কেশালীডাঙ্গা গ্রামের জোতদার প্যারীমাধব সরকারের এই বাড়ীটি পরিদর্শন করে গেছেন।
এদিকে, প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের তালিকায় শুধুমাত্র পলাশবাড়ী উপজেলার দরিয়ার দুর্গ মাউন্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দরগাহ, কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদ এবং গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিরাট রাজার ঢিবির নাম উল্লেখ রয়েছে। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত রংপুর বিভাগের সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তির তালিকায় এই তিনটি প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের মধ্যে দরিয়ার দুর্গ মাউন্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দরগাহ এবং কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদের কোন ছবি ও তথ্যই দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। অনেকের কাছে খোঁজ করেও দরিয়ার দুর্গ মাউন্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দরগাহ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি এবং প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের কোন সাইনবোর্ড বা ইতিহাস সম্বলিত কোন লেখা চোখে পড়েনি অন্য দুটি স্থাপনায়। শুধু স্থাপনা দুটির নাম তালিকায় উঠেছে, বাস্তবে সংরক্ষণের কোন দৃশ্য চোখে পড়েনি। নেই কোন সাইনবোর্ড বা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই এর ইতিহাস। আবার এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘গাইবান্ধাডটগভডটবিডি’তে জেলা সম্পর্কিতের মধ্যে জেলার ঐতিহ্য এবং পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় নেই দরিয়ার দুর্গ মাউন্ড ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দরগাহ এবং কাদিরবক্স মন্ডলের মসজিদের কোন তথ্য বা ছবি। ফলে এই দুটি স্থাপনার তথ্য অজানায় থেকে যাচ্ছে গাইবান্ধার ও সারাদেশের সুস্থ্য বিনোদন এবং ভ্রমণপ্রেমী মানুষদের কাছে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য জেলা জাতীয় ওয়েব পোর্টালে জেলার বিভিন্ন পুরাকীর্তি বিভাগে তাদের জেলার বহু পুরাতন মসজিদসহ অন্যান্য প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের তথ্য সন্নিবেশিত করলেও গাইবান্ধা জেলার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
ঐতিহাসিক স্থাপনার নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য নকশা সহজেই নজর কাড়ে জানিয়ে প্রবীন ব্যক্তি কবি সরোজ দেব বলেন, জেলার এসব প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন সরকারিভাবেই সংরক্ষণ করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। আর তা হলে একদিকে যেমন মানুষ এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারবে তেমনি সুস্থ্য বিনোদনেরও ব্যবস্থা হবে। এসব প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন দেখতে দেশের নানান প্রান্ত থেকে ভ্রমনপ্রেমী মানুষের পদচারনা ঘটবে। ফলে এসব এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটবে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রশাসনকে এসব স্থাপনার বিষয়ে সাইনবোর্ড তৈরি করে প্রচার-প্রচারণাও তাগিদ দেন কবি সরোজ দেব।
জাতীয় ওয়েব পোর্টালে সব প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন উল্লেখ না থাকা দুঃখজনক জানিয়ে গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরী অ্যান্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি বলেন, বিনোদন ও ভ্রমণপ্রেমী মানুষ নেটদুনিয়ায় খুঁজে থাকেন ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্পর্কে। আর তা খুঁজে না পাওয়ায় যুব সমাজ সুস্থ্য বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। আর অজানা ও অদেখা থেকে যাচ্ছে স্থাপনাগুলো। এজন্য জেলার প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন সংরক্ষণের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত। এই কমিটি দখল হয়ে যাওয়া স্থাপনা উদ্ধার, সংরক্ষণ ও জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবে।
এ বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, জেলার এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন আছে। যেসব প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বা সংরক্ষণের সুযোগ আছে সেসব নিদর্শন সংরক্ষণ করা হবে। আমরা এ বিষয়ে একটি উপকমিটি করবো। এই কমিটি এসব প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রত্মতত্ত¡ অধিদপ্তরকেও চিঠি দিয়ে জানানো হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন







© All rights reserved © uttorersomoy.com
Design BY BinduIT.Com