রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন
শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি :
বাজারে বিভিন্ন প্রকার প্লাষ্টিক সামগ্রীর ভিড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে দেশের চিরচেনা মৃৎ শিল্পের ব্যবহারিক জিনিসপত্র। একই পরিস্থিতি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের চওড়া পালপাড়ার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প পল্লীর।
মৃৎ শিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার কমে আসায় বদলে যাচ্ছে কুমারপাড়ার দৃশ্যপট।কুমার পাড়ার বাসিন্দাদের পরিবারে নেমে এসেছে দুর্দিন। ওইসব পরিবারের সদস্যরা এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন বাপ-দাদার পেশা। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে আখড়ে আছেন বহু কষ্টে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুতুল বানিয়ে শেষ সময়ে তুলির আচরে রংঙ্গের কাজসহ এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কুমার পাড়ার নারী ও পুরুষেরা। কেউবা গড়ছেন তৈজসপত্র, খেলনা, ফুলের টব ও ফুলদানী। আবার কেউ তৈরীপন্য বাজারজাত করতে পরিবহণে তুলছেন। আবার কেউ কেউ নতুন করে মাটি কিনে আনা ও মাটির মণ্ড তৈরীতে ব্যস্ত।
কুমারপাড়ার বাসিন্দারা জানান, প্লাষ্টিকের দাপটে এখন মানুষ মাটির জিনিস ব্যবহার করেনা। চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পাল পাড়ার অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এই পেশা। কিন্তু যারা শিশুকাল থেকে শুধু একাজেই নিয়োজিত তারা অন্য পেশায় যেতে না পেরে বাধ্য হয়ে কষ্ট করে হলেও একাজকেই উপার্জনের একমাত্র পথ হিসেবে ধরে রেখেছেন। তবে নতুন প্রজন্মের প্রায় সকলেই অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।
তাছাড়া মাটির সংকট, দামবৃদ্ধির কারনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং আবহাওয়ার কারনে নষ্ট হওয়া ও সময় বেশি লাগায় জিনিস তৈরী আগের মত ব্যাপকভাবে সম্ভব হয়না। ফলে অল্প পন্যেই বেশি আয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু চাহিদানুযায়ী আয় না হওয়ায় লাভ তো দূরের কথা পুঁজি হারাতে হয়। এতে অনেকেই আজ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের পেশাটি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
মালতি রানী (৫৫) বলেন, ছোট বেলাতেই বাবা মায়ের কাছ থেকে মাটির হাড়ি-পাতিল, কড়াই, মশলাদানী, পুতুল, ফুলের টবসহ প্রায় সব রকমের জিনিস বানানো শিখেছি। বিয়ে হয়ে এখানে এসে স্বামীর হাত ধরে নিয়মিত হয়েছি একাজে। স্বামীর সাথে আজও করে চলেছি। কিন্তু আগের মত আয় হয়না। বাজার নাই সেইভাবে। সন্তানেরা কাজ জানে কিন্তু তারা করেনা। করে কি হবে? বিক্রি না হলে পড়ে থাকবে। এতে পুুঁজি আটকে সমস্যায় পড়তে হবে।
নতুন প্রজন্মের তরুণ মৃৎশিল্পী শ্যামল বলেন, ন্যুনতম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসায় নামতে হয়। বড় অর্ডার পাওয়া গেলে আয়ের আশা করা যায়। নয়তো একবার পুঁজি আটকে গেলে মাঠে মারা যেতে হবে। কারণ উঠে দাঁড়ানোর মত আর কোন উপায় নেই। কেউ সহযোগীতার হাত বাড়ায়না। ফলে নতুনরা কেউ এই কাজে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়।
তার সাথে তাল মিলিয়ে রতন নামের যুবক আক্ষেপ করে বলেন, একে চাহিদা বা বাজার নাই। তার উপর প্রণোদনা বা এককালীন অনুদানও পাইনা। এমনকি করোনাকালেও সরকারী কোন পৃষ্ঠপোষকতা জোটেনি পালপাড়াবাসীর ভাগ্যে। অনিশ্চিত এই পেশায় যতই ঐতিহ্য থাক, বর্তমান বাস্তবতায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। একারনে সরকারের কোন সুদৃষ্টি নাই। তাই আগামী প্রজন্ম এই কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
পাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ করনি কান্ত পাল (৭০) বলেন, এই মৃৎশিল্প রক্ষার জন্য সরকারি কোনো সহযোগিতা বা সহজ শর্তে ঋণ পেলে আমরা উপকৃত হতাম। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু কিস্তি ও সুদের টাকা পরিশোধ করতে অনেক সময় গরু-ছাগলও বিক্রি করতে হচ্ছে। পালপাড়ার পাঁচ শতাধিক পরিবারের মৃৎশিল্পকে রক্ষায় সরকারের কাছে অনুরোধ এই ঐতিহ্য ও এর ধারক-বাহকদের জন্য একটু সুদৃষ্টি দিন। তা না হলে সহসাই এখাতটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।