শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:১৭ অপরাহ্ন
লালমনিরহাট প্রতিনিধি :
মাটি থেকে বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা দিঘলটারী গ্রামের কুমার পল্লীর অনেক অসহায় পরিবারের লোকজন।
তবে, উৎপাদিত মৃৎ শিল্পের জিনিসপত্র আগের মতো বাজারে না চলায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন মৃৎ শিল্পের কারিগররা।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা দিঘলটারী গ্রামের কুমার পল্লীতে মৃৎ শিল্পের এসব তৈজসপত্র তৈরি করা হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। এখানকার কুুুমার-কুমারিরা তাদের পূর্ব-পুরুষের ঐতিহ্যগত মাটি দিয়ে তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্রের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট থেকে আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন যেতেই চোখে পড়ে ধরলা নদীর পাড়ে ভারতীয় সীমান্ত। ভারতীয় এই সীমান্ত ঘেষা রাস্তা দিয়ে আসেপাশের গ্রামগুলোতে গেলেই চোখে পড়ে দিঘলটারী গ্রাম। আর এই গ্রামে পৌছুুুলেই চোখে পড়ে মাটি পোড়ানো ধোঁয়া আর ধোঁয়া।
এই গ্রামের কুমারদের গৃহিনীরা চুলায় এসব জিনিসপত্র পোড়ানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পোড়ানোর পর মৃৎ শিল্পের এসব জিনিস পত্রে সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আকর্ষনের জন্য বিভিন্ন রং দিয়ে নানা রকম অঙ্কন করা হয়ে থাকে।
মাটির তৈরী এসব জিনিসপত্র আগুনে পোড়ানোর জন্য একটি মিনি ভাটার মতো তৈরী করা হয়। সেখানে মাটির তৈরী জিনিস গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে প্রথমে পাট খড়ি দিয়ে আগুন দেয়া হয়। এরপর দেয়া হয় গবর দিয়ে তৈরী ঘুটো (খরি) অথবা চওলা খরি। এর উপরেই থাকে রোদে শুকানো মাটির তৈরী জিনিস গুলো। এই মিনি ভাটায় সেই সব জিনিসপত্র দুই/তিনদিন রাখার পর সেখান থেকে নামানো হয়। এরপর চলে রং তুলির কাজ।
কুমারদের তৈরী মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন তৈজসপত্র আগের মতো বর্তমান বাজারে আর সমাদর না পাওয়ায় কুমার পল্লীর অনেক মানুষই সংসারের খরচ চালাতে বিভিন্ন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তবে মাটি দিয়ে তৈরী জিনিস গুলো পুড়ানোসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে যে লাভ হয় তাতে সংসার চালানোও কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই ক্ষতি সামলাতে কুমার পল্লীর অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।
৬৭ বছর বয়সী শ্রীমতি পঞ্চমী পালের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, পাল বংসেই তার জন্ম। তাই ছোট বেলা থেকেই মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরী করতে তার বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। এরপর খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েও হয় একই এলাকার পাল বংশের অমুল্য চন্দ্র পালের সাথে। বিয়ের পরে স্বামীর পেশা মাটির তৈরী মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরীর কাজে তাকে সাহায্য করে আসছেন। সংসার জীবনে তাদের দুই ছেলে সন্তান রয়েছে।
এক সময় যখন মাটির তৈরী জিনিস পত্রের খুব কদর ছিল তখন তাদের বাড়ি থেকেই মাটির তৈরী এসব জিনিসপত্র লোকজন কিনে নিয়ে যেতো। কালের পরিবর্তনে বর্তমানে প্লাষ্টিক ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরী আধুনিক জিনিসপত্রের কারণে তাদের বাপ দাদার মৃৎ শিল্পের এ ব্যবসা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ছাড়া সরকারী ভাবে কোন সহযোগীতা না পাওয়ায় বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেকেই সর্বশান্ত হয়েছেন। তাই মাটির তৈরী জিনিসপত্র এখন না চলায় তাই তাদের বাব দাদার এ পেশা ছেড়ে অনেকেই সংসার চালাতে দিন মুজুরীসহ বিভিন্ন কাজের সাথে নিজেদের নিযুুুুক্ত করছেন।
শ্রীমতি পঞ্চমী পাল আরো বলেন, তার যখন বিয়ে হয় তখন তাদের সংসারে কোন অভাব ছিল না। বিয়ের ৬ বছরের মধ্যেই তাদের ঘরে দুই ছেলে সন্তান আসে। সংসারে অভাবের কারণে বর্তমানে বড় ছেলে সন্তোষ চন্দ্র পাল রংপুরে লেবারের কাজ করে (বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে কোন কাজ না থাকায় বাড়িতে আছেন)। আর ছোট ছেলে প্রশান্ত চন্দ্র পাল তার বাপ দাদার এই ব্যবসাকে ধরে রেখেছে। সেই ছেলেও একই অবস্থা। করোনার কারণে মাটির তৈরী এসব জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রয় করতে পারছেন না। তাই বাড়িতে যে কয়টাকা বিক্রি হয় তা দিয়েই এক বেলা কোন রকমে আধাপেট খেয়ে বেঁচে আছি।
কুমারটারীর ৬৫ বছর বয়সী অমুল্য চন্দ্র পাল বলেন, জন্মের পর থেকেই দেখছি তার বাপ দাদারা এ ব্যবসা করে আসছেন। পাল বংশের এইকুমারটারীতে ২৭টি পরিবার এই ব্যবসার সাথে জড়িত। সেই সময় তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। অল্প বয়সেই তিনি তার বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নেন। তিনি বলেন, চাহিদা থাকায় একসময় মাটির তৈরী তাদের ৫১ প্রকার মাটির তৈরী জিনিসপত্র বাড়ি থেকেই কিনে যেতেন অনেকে। কালের পরিবর্তনে এবং প্লাষ্টিক ও সিমেন্টের তৈরীর জিনিসপত্রের কারণে বর্তমানে তাদের এ ব্যবসা প্রায় বিলুপ্তি পথে। আগের মতো তাদের এ ব্যবসা আর চলে না। তাই সংসার চালাতে এই পাল বংশের অনেকেই অন্যের জমিতে এবং রিক্সা ভ্যান চালিয়ে জিবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, তাদের মাটির তৈরী জিনিসপত্রের এই ব্যবসা আগের মতো আর চলে না। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কুয়া দেখা যেতো। কুমারীটারীর এই কুমারদের তৈরী মাটির পাট দিয়েই এই কুয়া তৈরী হতো। আর কুয়া থেকে মাটির তৈরী কলস দিয়েই পানি নিয়ে আসতেন নারীরা। মাটির হাড়িতেই বাড়িতে ভাত রান্না করা হতো। খাওয়া দাওয়াও করতেন মাটির তৈরী প্লেটে। পানি খেতেন মাটির তৈরী গ্লাসে। কিন্তু এখন আর ওসব কিছুই চোখে পড়ে না। প্লাষ্টিক, চিনামাটি ও সিমেন্টের কারণে পাল বংশের এই প্রাচিন ব্যবসা আজ বিলুপ্তির পথে। তবে সরকার থেকে সহযোগীতা পেলে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া এই মৃৎ শিল্পকে আবারও বাচাঁনো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
পাশের বাড়ির পঞ্চাশোর্ধ বিধবা উর্মিলা বালা পাল বলেন, তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানসহ ছয় সদস্যের সংসারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন তার স্বামী। ভারে ফেরি করে তার স্বামী বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরী বাঘ, সিংহ, হরিণ, ঘোড়া, টব, মাটির ব্যাংকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। সারাদিন বিক্রি করে যে আয় হতো তার একটি অংশ মাটির কেনার জন্য রেখে কোন রকম সংসার চালাতে হতো। করোনা পরিস্থিতির কারণে ফেরি করে বিক্রি বর্তমানে বন্ধ আছে। এই কষ্টের মধ্যেই তাদের তিন মেয়ের বিয়ে দেন। ছেলে বড় হওয়ায় সে তার বাবাকে সহযোগীতা করতে থাকে। কখনো তার বাবাকে আবার কখনো অন্যের জমিতে কৃষি কাজ সংসারে সহযোগীতা করে আসছে। দুই বছর আগে ছেলেরও বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে তার স্বামী মারা গেলে তিনিও ভেঙ্গে পড়েন। চিকিৎসার অভাবে এর মধ্যেই শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে থাকে। চোখেও ঠিক মতো দেখতে পাননা।
তাই আগের মতো মাটির তৈরী জিনিসপত্র বানাতে পারেন না। ছেলে ও ছেলের বউ অন্যের কাজ করার পর যতটুক সময় পায় ওই সময়েই মাটির কিছু খেলনা তৈরী করেন। পরে সেগুলো আগনে পুড়িয়ে কাধেঁ করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন তিনি। এভাবেই বর্তমানে তার সংসার চলছে। তবে সরকারী কোন সাহায্য বা সহযোগীতা এখন পর্যন্ত পাননি বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি বিধবা হওয়া লক্ষী বালা পাল বলেন কিছুদিন আগে তার স্বামী নগেন চন্দ্র পাল মারা যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে অতিকষ্টে এক বেলা খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছি। তাদের মাটির তৈরী জিনিস বাজারে তেমন বিক্রি না হওয়ায় সংসার চালাতে বড় ছেলে রবিন চন্দ্র পাল এখন ভ্যান চালায়। অন্য সময় যখন মাটি পাওয়া যায় তখন মাটির তৈরী বিভিন্ন খেলনা তৈরী করে বাজারে বাজারে বিক্রি করে। ছোট ছেলে অন্যের দোকানে কাজ করে।
সেই সাথে এসব মাটির তৈরী জিনিসপত্র তৈরীর জন্য মাটিও পাওয়া যায় না। মাটির তৈরী জিনিসপত্র অর্থাৎ মৃৎ শিল্পের কারিগররা গুলো অর্থাৎ পাল বংশের মানুষ গুলো বরাবরেই সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। অথচ ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিগন তাদের সরকারী সাহায্য এনে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর আর তাদের কথা মনে রাখেনা।
দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামান প্রামানিক ছালেক বলেন, কুমার পল্লীর ২৭ পরিবারের সকলের নামের তালিকা করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানকার কয়েকজনের বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।