বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪২ অপরাহ্ন




সচেতন-অচেতনতায় ‘যতদোষ-নন্দঘোষ’!

সচেতন-অচেতনতায় ‘যতদোষ-নন্দঘোষ’!

রহিম আব্দুর রহিম
মাস পেরিয়ে যাচ্ছে; কোন কাজ নেই। পড়া-শোনা আর লেখা-লেখির মধ্যে সময় কাটছে। ভাড়া বাড়িতে থাকি। পাশে যারা ছিলো, করোনার তাড়নায় বাড়ি ছেড়েছে। চৌ-চালা টিনের আধা-পাঁকা একটি ঘরে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বসবাস করছি। একা মানুষ; সকালে হালকা নাস্তা, দুপুরের খাবার হোটেলে, রাতে নিজেই রান্না করে খেয়ে আসছি। করোনাকালে হোটেল বন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি, শহর লকডাউন। অবস্থা কঠিন। শহর থেকে ৯ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে এক ছাত্রের বাড়িতে সকাল ১০ টার মধ্যেই হাজির হই। ওই বাড়ির দেড় বছর বয়সের সিফাত নামের এক শিশুর সাথে ৬ মাস যাবৎ ভাব। ওর বাবার ক্রয় করা একটি পরিত্যক্ত ভাঙ্গা টিনের ঘরে বসে পড়া-শোনা করি, ফাঁক-ফোঁকরে সিফাতকে নিয়ে খেলা করে সময় কাটাচ্ছি। টেলিভিশন আছে, দেখিনা। ফেইসবুকে হঠাৎ ঢুকি, তবে অনলাইনে দেশ-বিদেশের সংবাদ দিনশেষে একবার দেখে নিচ্ছি। পত্রিকা না পড়লে যেখানে ভাত হজম হতোনা, সেই পত্র-পত্রিকার উপর প্রচন্ড অনীহা। ব্যাক্তিগতভাবে আমি একজন সৌখিন ক্রীড়ামোদী ও বিনোদনপ্রিয় নাট্যকর্মী। সারাদিন সামাজিকতায় সময় কাটে, শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সাথে মেলামেশা তো আছেই, অথচ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে এ যেনো এক অসামাজিক প্রাণির মত অবস্থা। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিডিয়াগুলোতে ‘করোনা’, ‘লকডাউন’, ‘চালচোর’, ‘তেলচোর’ ছাড়া কোন বিনোদনের খবর নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মৃত্যুর খবর,আতংকের সংবাদ। রাতে ঘুমানোর আগেও একই সংবাদ। একি আশ্চর্য! ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বারানাসিতে এক নাট্য উৎসবে গিয়েছিলাম, আমাদের নাটকের কাহিনী তৎকালীন বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের জনমানুষের জীবন-যাত্রা নিয়ে। ভারতের এক বোদ্ধাল দর্শক জিজ্ঞেস করলেন, “নাটকটি কোন রসে রচিত?” বললাম, “করুন রসে”; উনি বললেন,“আপনার নাটক দেখা সম্ভব না।” কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি উত্তর দিলেন,“সারাদিন নিরানন্দ একটানা পরিশ্রম করি; দিন শেষে একটু আনন্দ বিনোদনের জন্য হলে আসা, সেখানেও যদি কান্না-কাটির রোল! তবে আসা সম্ভব না।” তিনি আমার নাটক দেখেছেন কি-না জানি না। তবে বিষয়টি আমি ভেবেছি, এখনও ভাবি। অদৃশ্য মহামারীর খবর কে না জানে? পৃথিবীর ১৮৫ টি দেশের অজোপাড়া গাঁয়ের দূরন্ত শিশু থেকে বিশ^ নেতৃত্বের বড় বড় কর্তার নখদর্পনে আজ করোনা ভাইরাসের আক্রমনের খবর, দু:সংবাদ। ‘সচেতন’ শব্দটির মানে নিজের বিবেক বিবেচনায় কোন বিষয় অনুভব করা এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা। অপরদিকে ‘অচেতন’ অর্থাৎ ঘুমন্ত, অন্ধ, বিবেকবুদ্ধিহীন প্রাণী। অথচ আমরা এমন একটি জাতি আমরা সচেতন হই না , সচেতন করতে হয়। সচেতনতার নামে প্রতিদিন যে খবরা-খবর দিবা-রাত্রি কানে আসছে,এতে এক শ্রেণির মানুষের উপর অন্য এক শ্রেণির স্বার্থান্বেস্বীরা নেমেছে। মজুতদারী, দ্রব্য মূল্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, ত্রাণের চাল-ডাল-তেল নিয়ে ছলচাতুরি, চুরি-চামারী অব্যাহত রেখেছে। করোনার ফাঁদে সারা পৃথিবীর যে অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে তা শত বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিপুল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ যে গতিতে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তাতে প্রচন্ড ধাক্কা খেলো। বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব বৈশাখ। এই বাজারে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়; তা এবছর ভেস্তে গেছে। কুমার-কামার, বাঁশ-বেত এবং তাঁত পল্লীর কারিগররা পথে বসেছে। কৃষি, কাচাঁ পন্যের দাম না থাকায় কৃষকরাও পথে বসার উপক্রম, পরিবহন শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয়, গার্মেন্টস শিল্পের উৎপাদন বন্ধ, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ছুটি, বিনোদন পাড়ায় ভ‚তুড়ে অবস্থা; বর্তমান সরকারের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যৎ ভেবে জাতির এ ক্রান্তিকাল পাড়ি দিতে বিভিন্ন প্রনোদনা ঘোষণা করেছেন। গত ১৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন,“দেশের ৫০ লাখ মানুষকে রেশন কার্ড দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। স্বল্প আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার জন্য ৫ লাখ টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় দেশে ৬ হাজার ২ শতটি আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করা হয়েছে।” সব মিলিয়ে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, ক্রান্তিকাল ঠেকাতে। হাজারো রোগ-ব্যাধি, উথান-পতন, আপদ-বিপদের মধ্যেই দেশ সচল রাখতে হবে, অন্যথায় যা হবার তাই হবে। স্বাস্থবিধি মেনে দেশের সকল উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ, অফিস-আদালত চালুর ব্যবস্থা জরুরী হয়ে পরেছে। যে জাতি নিজে বাঁচতে চায় না, সেই জাতিকে আইন দিয়ে কতক্ষণ রক্ষা করা সম্ভব! সম্প্রতি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলোচক মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় লাখো মানুষের ভীড় জমেছিল। যারা এই জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের প্রায়ই ইসলাম সচেতন ও মৃত ব্যাক্তির ভক্ত মানুষ। জানাজা ফরজে কেফায়া, একথাটি জানার পরও এই মহামারীর সময়ে উৎসবের আমেজে যানাজায় উপস্থিত হয়েছিল। এই সচেতন আলেমরা জানেন নবী করিম (সা:) এর বাণী। হযরত উমর (রা:) এর যুগের মহামারীকে কেন্দ্র করে নবী করিম (সা:) আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা:) এর সম্মুখে বলেছিলেন,“যখন তোমরা কোন এলাকায় মহামারীর সংবাদ শুনতে পাও, তখন তার ওপর দু:সাহস দেখিয়ে এগিয়ে যেও না, আর যেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে সেখানে যদি তুমি অবস্থান কর তবে এ অবস্থায় তুমি ওই স্থান থেকে অন্য স্থানে যেও না।”(মুসলিম: ৫৫৯১)। অথচ এটা জানার পরও একটি গোষ্ঠী জানাজায় ভীড় করলো। ফলে ওই জায়গার দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার কিংবা জবাবদিহিতার আওতায় নেওয়া হলো। অথচ একই সময় ভারতের নিজামুদ্দিনে তাবলিগ মারকাজে সরকারি নিষেধ অমান্য করে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ওই দেশের সরকার। করোনাকালের প্রথম থেকে অদ্যবধি বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসনের যে ভ‚মিকা তা প্রশংশনীয়। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জামিয়া রহমানিয়া বেলতল মাদরাসা প্রাঙ্গনের ঘটনায় পুলিশের উপর যে এ্যাকশন তার উর্ধ্বতনরা নিয়েছেন তা কেউ ভাল চোখে দেখছে না। কথায় বলে,“যতদোষ নন্দঘোষ।” বরং যারা রাষ্ট্রের নিষেধ এবং ধর্মীয় আদেশ না মেনে এমনটি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবী। অবরুদ্ধ দেশ সচলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সঙ্গেই থাকতে হবে নিশ্চিত করতে, ক) সাপ্তাহিক সকল হাট নিষিদ্ধ করে, প্রয়োজনীয় কেনা বেচার জন্য দৈনিক বাজার ওয়ানওয়ে ও সাটডাউন পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক চালু, খ) মিল-ফ্যাক্টরি শিফট অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাইরোটেশন উৎপাদন কর্ম পরিচালনা, গ) যাত্রীবাহী পরিবহন আন্তজেলা (অনরানিং পদ্ধতিতে) চালু, ঘ) মালবাহী পরিবহন রাত্রীকালীন চালু, ঙ) কোনক্রমেই আক্রান্ত এলাকা (গ্রাম, শহর, মিল-ফ্যাক্টরি)’র লোকজন অন্য এলাকায় যাবে না, একাইভাবে আক্রান্ত এলাকায় অন্য এলাকার লোকজন প্রবেশ করবে না। চ) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই বা ততোধিক শিফট করে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা, ছ) বিভাগীয় ও রাজধানী শহরে শুধুমাত্র অফিসিয়াল যানবাহন ছাড়া সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। উপরে বর্নিত মতামত বিশ্লেষণ করে অবরুদ্ধ দেশ সচল করার বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন কিনা? সর্বোপরি বলতেই হয়, শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হকের অমরকথন,“যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা শিখবে কিভাবে? যারা পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে তার সন্তানকে ডোবায় নামতে দেয় না, কিভাবে ওই সন্তান আটলান্টিক পাড়ি দিবে?” বর্তমান অবস্থায় যদি শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হক বেঁচে থাকতেন তবে বলতে বাধ্য হতেন,“যে জাতি নিজেই নিজেকে মেরে ফেলতে চায়, তাকে বাঁচাবে কে?”
লেখক : শিক্ষক, নাট্যকার ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন







© All rights reserved © uttorersomoy.com
Design BY BinduIT.Com